প্রকাশিত: ২০/০১/২০১৮ ৮:৩৩ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:৫৩ এএম

উখিয়া নিউজ ডটকম::
মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রাক্কালে বিক্ষোভ শুরু করেছে প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনসহ বিদেশি সংস্থাগুলোও ‘এই মুহূর্তে’ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করছে। ফেরার জন্য তার কয়েকটা শর্তও দিয়েছে। এদিকে দেশে ফিরতে ইচ্ছুক এক সর্দার (মাঝি) ও আরেক সর্দারের ভাইকে গতকাল রাতে গুলি করেছে সন্ত্রাসী। বর্তমানে তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এমন পরিস্থিতিতে শীঘ্রই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে কি না তা নিয়ে স্থানীয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তিন দিন আগে একটি চুক্তি করেছে মিয়ানমার। চুক্তি অনুযায়ী, সপ্তাহে ১৫০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে দেশটি। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়। আর এ আতংকের জের ধরে প্রস্তুতির পর গতকাল শুক্রবার থেকে বিক্ষোভে নেমেছে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালংয়ের নতুন রোহিঙ্গা টালে গতকাল মাগরিবের নামাজের পর হাজার খানেক রোহিঙ্গা হাতে ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়। এসময় বিক্ষোভকারী রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়।

তারা বলছে, মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, বসতভিটা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের ফেরত যাওয়ার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে তারা দেশে ফিরতে চাইছে না।

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাও (ইউএনএইচসিআর) মনে করছে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত না হলে তাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং জাতিসংঘও বলছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্বেচ্ছায় হতে হবে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা বলেন, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের অনেকেই ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তাদের কাছে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তারা মিয়ানমারে কিছু পরিবর্তন দেখতে চান। যেমন তাদের নাগরিকত্ব এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান। তারা চান তাদের মৌলিক অধিকারগুলো।

তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াটা যাতে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে হয়, সেটা দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাদের ফিরে যাওয়াটা যেন টেকসই হয়। তাদের যেন আবার ফিরে আসতে না হয়। তবে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং থাকার ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য বিষয়ে মিয়ানমার ব্যবস্থা নেবেণ্ডএমন আশ্বাস বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার তাদের বলেছে, যেসব রোহিঙ্গা দেশে ফিরে যাবে তাদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হবে।

কিন্তু রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা আরাকানে (রাখাইন) থাকার জন্য নিরাপদ পরিবেশ চান। সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থাকুক সেটাও চান তারা।

ফিরতে ইচ্ছুক ২ মাঝিকে গুলি

উখিয়া প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরা না ফেরা নিয়ে বিভক্তি চরম আকার ধারণ করছে। এ নিয়ে গতকাল রাতে পৃথক ঘটনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে রোহিঙ্গা সর্দারসহ (মাঝি) ২জন আহত হয়েছে। আহতদের কুতুপালং রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা মাঝিরা জানান, রাত সাড়ে ৮টার দিকে ১০–১২ জনের এক দল সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী উখিয়ার থাইংখালী তাজনিমার খোলা অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবিরের ডি বহ্মকের হেড মাঝি (সর্দার) মো. ইউসুফকে (৩৮) ৩ রাউন্ড গুলি করে চলে যায়।

পালংখালী ইউনিয়নের স্থানীয় ওয়ার্ড গ্রাম পুলিশ রফিক উদ্দিন জানান, খবর নিয়ে জেনেছি, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিরোধী একটি গ্রুপ এ ঘটনায় জড়িত। এ ঘটনার প্রায় আধ ঘণ্টা পর একই সন্ত্রাসীরা তাজনিমার খোলা ক্যাম্প সংলগ্ন বালুখালী–২ অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবিরে এসে ওই শিবিরের হেড মাঝি আরিফ উল্লাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এসময় গুলি লক্ষ্যভেদ হয়ে মাঝির ভাই মৌলভী আজিম উল্লাহর গায়ে লাগে। তিনি আহত হন। রোহিঙ্গারা ধাওয়া করে এক সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করে।

ঘটনার পর উখিয়া থানার ওসির নেতৃত্বে এক দল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। আহতদের কুতুপালং রেড ক্রিসেন্ট ফিল্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুলিবিদ্ব রোহিঙ্গা মাঝি মো. ইউসুফের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি। তিনি জানান, গত রাতে মো. আলম (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে দুই রাউন্ড গুলি, ১টি বিদেশি অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গারা জানান, অধিকাংশ রোহিঙ্গা দেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আল ইয়াকিন বা আরসা সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হচ্ছে। এরা বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ রোহিঙ্গাকে স্বজনহারা, ঘর, দেশহারা করার পর এখানেও শান্তি দিচ্ছে না।

কয়েকটি শর্ত

বিডিনিউজ জানায়, নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতির মধ্যে নাগরিকত্বের অধিকার, ভূমি ফিরে পাওয়া এবং হত্যা–ধর্ষণ–লুটপাটের বিচারসহ কয়েক দফা শর্ত নিয়ে সামনে আসার পরিকল্পনা করছেন কুতুপালং ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা নেতারা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ছয়জন রোহিঙ্গা নেতা বার্মিজ ভাষায় হাতে লেখা একটি স্মারকলিপির খসড়া তৈরি করেছেন। সেখানেই ওই দাবিগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৪০টি গ্রামের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা। তাদের স্মারকলিপি চূড়ান্ত হলেই তা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে তা তুলে ধরা হবে।

ওই খসড়ায় বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকার যতক্ষণ না এসব দাবি পূরণ করছে, ততক্ষণ আশ্রয় শিবির থেকে কোনো রোহিঙ্গা মুসলমান ফিরে যাবে না। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে :

ক. দীর্ঘদিন নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে সরকারি ঘোষণা দিতে হবে। মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকাতেও রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে।

খ. যে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, সেই ভূমি, বাড়িঘর, মসজিদ আর স্কুল তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। সেনা অভিযানের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

গ. সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে যেসব ‘নিরপরাধ’ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে।

ঘ. মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এবং ফেইসবুক পেইজগুলোতে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ছবিসহ যে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে।

কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে যে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে রয়টার্স কথা বলেছে, তারা জানিয়েছেন, তাদের স্মারকলিপি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ক্যাম্পে থাকা ৪০ রোহিঙ্গা গ্রামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেই দাবিগুলো তারা লিপিবদ্ধ করেছেন। আর স্মারকলিপি যেহেতু দেওয়া হয়নি, সেহেতু আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এখনই কোনো মন্তব্য করতে চায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

গত বছর ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অধিকাংশই আছে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে। গত ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে আগামী সপ্তাহে শুরু করে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। রয়টার্স লিখেছে, এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করতে যে বিপুল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, রোহিঙ্গাদের এই দাবিনামা তার একটি নমুনা।

ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য সীমান্তে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে তাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে। পরে সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে।

এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামে ফিরতে পারবে, নাকি তাদের ক্যাম্পেই থাকতে হবে সে বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ মুহূর্তে প্রত্যাবাসন শুরুর বিরোধিতা করেছে। তাদের ভাষায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মনে এখনো ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের দগদগে ক্ষত। এই অবস্থায় তাদের ফেরত পাঠানো সময়োচিত হবে না।

পাঠকের মতামত

গাজীপুরের সাংবাদিক তুহিন হত্যায় সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজার’র নিন্দা ও প্রতিবাদ

গাজীপুরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে নির্মমভাবে হত্যার ...

উখিয়া বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক সাইফুর রহমান সিকদারের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি উখিয়া উপজেলা শাখার সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক সাইফুর রহমান সিকদার এর আবেদন ...

নাইক্ষ্যংছড়িতে নতুন সদস্য ও নবায়ন কর্মসূচীতে জাবেদ রেজাবিএনপি পরিচয়ে চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজির স্থান নাই

শামীম ইকবাল চৌধুরী, নাইক্ষ্যংছড়ি: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির, নতুন সদস্য সংগ্রহ ও পুরাতনদের ...